বুধবার, ৮ এপ্রিল, ২০১৫

আমাদের খালিয়াজুরী

খালিয়াজুরী বাংলাদেশের নেত্রকোনা জেলার অন্তর্গত একটি উপজেলা
== অবস্থান ==২৪°-৪১´ উত্তর অক্ষাংশ ও৯১°-০৪´ পূর্ব দ্রাঘিমাংশে খালিয়াজুরী উপজেলা । এর উত্তরে মোহনগঞ্জ, দক্ষিণে কিশোরগঞ্জ জেলার ইটনা, পশ্চিমে মদন, ও পূর্বে সুনামগঞ্জ জেলার শাল্লা। ==প্রশাসনিক এলাকা ==খালিয়াজুরী উপজেলায় ৬টি ইউনিয়ন। খালিয়াজুরী সদর, চাকুয়া, কৃষ্ণপুর, নগর, গাজীপুর ইউনিয়ন। সমগ্র উপজেলায় গ্রামের সংখ্যা- ৬৮টি। == ইতিহাস ==১৮৯৬ খ্রীস্টাব্দে খালিয়াজুরী কেন্দুয়া থানার একটি ফাড়ি থানা স্থাপন করা হয়। ১৬ জুন ১৯০৬ খ্রীঃ খালিয়াজুরী পুনাঙ্গ থানায় রূপনেয়।
সপ্তম পর্যায়ে ১৯৮৩ সালে ২৮ ডিসেম্বর খালিয়াজুরীকে উপজেলায় রূপান্তর করা হয়ে ছিল।
কথিত আছে খালিয়াজুরীতে এক সময় কামরূপের রাজধানী প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। চর্তুদশ শতাব্দীর মধ্যভাগে জিতারী নামক জনৈক সন্ন্যাসী কর্তৃক অধিকৃত হলে এ অঞ্চল কমরূপের শাসনচ্যুত হয। পরবর্তীকালে খালিয়াজুরী পরগনা ভাটি অঞ্চলের অধীশ্বর ঈশাখার শাসনেছিল। এ ভাটি মহাল তৎকালে সরকার বাজুহা জলকর মহালের অর্ন্তগত ছিল। ঈশাখাঁর মৃত্যুর পর এ পরগনা তার পরিষদ মজলিশদের হস্তগত হয়েছিল। অষ্টাদশ শতাব্দীতে এ পরগনা মজলিশদের হাত থেকে হোমবংশীয়দের শাসনাধীন হয়ে পড়ে। ১৭৮৭ খ্রীস্টাব্দে ময়মনসিংহ জেলা বন্দোবস্তের সময় এ পরগনা রামশংকর চৌধুরী, জয় প্রসাদ চৌধুরী, অনুপ নারায়ণ চৌধুরী, মহনরায় চৌধুরী, মানিকরাম চৌধুরী, আবুওয়াল্লা চৌধুরী, মুহাম্মদ গহুর, মুহাম্মদ রুশন ও মুহম্মদ রঞ্জি এই কয়জন এ পরগনার মালিক ছিল।
১২০৪ বঙ্গাব্দে মালিকগন ঋণগস্থ হয়ে পরগনার আট আনা হিস্যা খাজে ওয়াসাল নামক এক আম্মানীর কাছে ৫০০১/- টাকায় বিক্রি করে দেয়। বাকী আট আনা খাজে ওয়াসীলের কাছেই ৯বছর মেয়াদে ইজারা পত্তন দেয়। ১২১৫ বঙ্গাব্দে মালিকগন এই আট আনা জমিদারী ধানকুড়ার রামকৃষ্ণ ও রাজকৃষ্ণ রামের কাছে বিক্রি করেদেয়। আম্মানী খাজে ওয়াসিলের মৃত্যুর পর তার দু’ কন্যা আট আনা জমিদারীর মালিক হয়। এই কন্যাদ্বয়ের এক কন্যা চার আনা অংশ করটিয়া জমিদার সায়াদত আলী খাঁ-র নিকট ২২০০০/- টাকায় বিক্রি করে। অন্য কন্যার অংশ রামকৃষ্ণ ও রাজকৃষ্ণ রায়ের উত্তরাধিকারী গিরিশ ও গোবিন্দ বাবুর কাছে ৩২০০০/- টাকায় বিক্রি করেদেয়। এভাবে ধানকুড়ার জমিদারগন খালিয়াজুরী পরগনার ১২ আনা ও কয়টিয়ার জমিদার চার আনা জমিদারীর মালিক ছিল।
==জনসংখ্যার উপাত্ত ==হিন্দু, খ্রিস্টান ও মুসলিম এ তিন’ ধর্মের লোকের খালিয়াজুরী উপজেলায় বসবাস করে। মুসলমানরা সুন্নী সম্প্রদায়ের। হিন্দু ধর্মাবলম্বীর সংখ্যা মুসলমানদের চেয়ে আনুপাতিক হারে বেশী। হিন্দুদের নমঃদাস পদবীধারীর সংখ্যাই বেশী। ১২,১২৮ টি দাস পরিবার রয়েছে। উচ্চ বর্ণের হিন্দুর সংখ্যা কম। কথিত আছে মৈয়মনসিংহ গীতিকার মহুয়া গীতিনাট্যের নায়ক নদের চাঁদের বাড়ী খালিয়াজুরী ছিল। নদের চাঁদের বাড়ী- ভিটাটি ঠাকুর বাড়ীরভিটা নামে খ্যাত। খালিয়াজুরী উপজেলায় এক সময় ঘাটু গান প্রচলিত ছিল। ঘাটু গানের দর্শক থাকলেও ঘাটুগানের দল করার এখন লোক নেই। == শিক্ষা == খালিয়াজুরী উপজেলার শিক্ষার হার ৩৫.৬৮%। শিক্ষার হার কম। ==অর্থনীতি==নৌকা তৈরি এ অঞ্চলের অন্যতম দারু শিল্প। দারু শিল্পীরা শুধু নৌকাই তৈরি করেন না নৌকায় খোদাই করে কারু কাজও করেন। অনেক নৌকা ময়ুরের আকৃতি করে তৈরি হয়। অনেক নৌকা বিভিন্ন রং দিয়ে রঞ্জিত করা হয়। খালিয়াজুরীর প্রধান কৃষিপণ্য ধান। মাছধরা খালিয়াজুরী অঞ্চলের অন্যতম আয়ের উৎস। ১২,১২৮টি জেলে পরিবারের ৩৬,৩৫৪ জন মানুষ মাছ ধরার সঙ্গে সম্পৃক্ত। সমগ্র উপজেলায় ১২৪২টি সরকারী পুকুর ও ২৫টি জল মহাল রয়েছে। এ উপজেলার প্রতিবছর ২৪৬০ মেট্রিক টন মাছ উৎপাদন হয়। স্থানীয় চাহিদা পুরনোর পর বাকী মাছ দেশের বিভিন্ন স্থানে চলে যায়। == কৃতী ব্যক্তিত্ব ==(১) কালী কুমার দাস : খালিয়াজুরী উপজেলার ইছাপুর গ্রামে কালীকুমার দাস জন্ম গ্রহণ করেন। গত শতাব্দীর ত্রিশের দশক থেকে ষাটের দশক পর্যন্ত টপ্পার আসরের খ্যাতিমান কবিয়ালদের অন্যতম ছিলেন। (২) গিরিজানাথ রায় : খালিয়াজুরী উপজেলার খলাপাড়া গ্রামে ১৮৮৩ সালে গিরিজানাথ রায় জন্ম গ্রহণ করেন। তিনি প্রথমে ময়মনসিংহে শিক্ষকতা পরে নেত্রকোণা কোর্টে আইন পেশা শুরু করেন। পাশাপাশি রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত হন। ১৯২১ খ্রীস্টাব্দে নেত্রকোণা মহুকুমা কংগ্রেসের সভাপতি ছিলেন। গিরিজাননাথ রায় কবি গুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রতিষ্ঠিত লোকশিক্ষা পরিষদের নেত্রকোণা শাখা সংগঠনের প্রধান ছিলেন। (৩) সুধীর কুমার চৌধুরী : খালিয়াজুরীর সুধীর কুমার চৌধুরী ১৮৯৭ সালে জন্ম গ্রহণ করেন। তার কবিতা সর্বপ্রথম ময়মনসিংহের সৌরভ পত্রিকায় মুদ্রিত হয়। সৌরভে মুদ্রিত কবিতাগুলো পড়ে প্রবাসী পত্রিকার সম্পাদক রামানন্দ চট্টোপাধ্যায় আকৃষ্ট হন। কবি সুধীর কুমার চৌধুরীকে সৌরভ সম্পাদক কেদারনাথ মজুমদার এর মাধ্যমে ডেকে নেন। পরে তাঁকে প্রবাসী পত্রিকার সহকারী সম্পাদক হিসেবে নিযুক্ত করেন। প্রেমকরে সুধীর কুমার চৌধুরী প্রবাসী সম্পাদক এর কন্যা সীতা দেবীকে বিয়ে করে বার্মায় চলে যান। বার্মায় প্রায় দশ বছর কাটানোর পর রামানন্দ তাদের সেখান থেকে ফিরিয়ে আনেন। তিনি সারা জীবন প্রবাসী পত্রিকার সহকারী সম্পাদক ছিলেন। তার উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ ‘জলের লিখন’‘শৃঙ্খল’ ‘অবছায়া’। শৃঙ্খল উপন্যাসটি ১৩৩৯ বঙ্গাব্দে ২২ পর্বে প্রবাসী পত্রিকায় মুদ্রিত হয়ে ছিল। উপন্যাসটি গ্রন্থাকারে বেরোয়নি। তিনি ছিলেন মূলত কবি। তার কবিতার আকার দীর্ঘ ছিল। (৪) উকিল মুন্সী : খালিয়াজুরী নুরপুর বোয়ালী গ্রামে ১৮৮৫ সালে উকিল মুন্সীর জন্ম। তার প্রকৃত নাম আব্দুল হক আকন্দ। ডাকনাম উকিল। মসজিদে ইমামতি করতেন বলে তিনি উকিল মুন্সী হিসেবে পরিচিত ছিলেন। তিনি বাউল সাধক ও গায়ক ছিলেন। মোহনগঞ্জ উপজেলার জালালপুর গ্রামে তিনি প্রেম করে বিয়ে করে ছিলেন। উকিল মুন্সীর মসজিদে ইমামতীর পাশাপাশি বাউল গান গাওয়া নিয়ে এলাকায় বেশ চাঞ্চলের সৃষ্টি হয়েছিল। তাঁর বিরহী গানে বিরহ প্রানে সারা সৃষ্টি করেছিল। উকিল মুন্সীর অনেক জনপ্রিয় গান এখনো সাধারণ মানুষের মুখে মুখে। তার কয়েকটি জনপ্রিয় গান বাংলা চলচ্চিত্রে সংযোজন হয়েছে। (৫) মোস্তাফা জব্বার : খালিয়াজুরী উপজেলার কৃষ্ণপুর গ্রামে ১৯৪৯ সালে মোস্তাফার জন্ম গ্রহণ করেন। বাংলা কী- বোর্ড বিজয় এবং বাংলা সফটওয়ার বিজয় এর উদ্ভাবক। দেশে কম্পিউটার শিক্ষা প্রসারে মোস্তাফা জব্বার গুরুত্ব পূর্ণ ভুমিকা পালন করছেন। এক সময় তিনি নিপুন, রূপসী, আনন্দ বিচিত্রা পত্রিকা সম্পাদনা করতেন। বাংলা নিউজ সার্ভিস আবাস এর সম্পাদক হিসেবে তিনি খ্যাতি লাভ করেছেন। সকল কম্পিউটার বিশেষজ্ঞ হিসেবে তিনি অত্যন্ত সুপরিচিত। তিনি নিজ গ্রামে একটি কলেজ প্রতিষ্ঠা করেন। (৬) হাদিস উদ্দিন : খালিয়াজুরী উপজেলার মেন্দীপুর গ্রামে ১৯৪৯ সালে হাদিস উদ্দিনের জন্ম। তিনি ঢাকা বিশ্ব বিদ্যালয় থেকে প্রান রসায়ন ও পুষ্টি বিজ্ঞান বিষয়ে অর্নাসসহ এম.এস.সি ডিগ্রী লাভ করেন। সহকারী পুলিশ সুপার হিসেবে হাদিস উদ্দিন কর্মজীবনে প্রবেশ করেন। সর্বশেষ পুলিশের ইন্সপেক্টর জেনারেলে পদোন্নতি লাভ করেছিলেন। তিনি ১৯৯৮ সালে দিল্লীস্থ বাংলাদেশ মিশনে কাউন্সিলর এবং পরবর্তীতে মিনিস্টার হিসেবে ২০০৩ সাল পর্যন্ত কর্মরত ছিলেন। ১৯৯৩ সালে তিনি জাতিসংঘ বাহিনীর অধীনে কম্বোডিয়ার একটি প্রদেশে ৩৬টি দেশের সৈন্যবাহিনীর কমান্ডার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। (৭) সুলতান আহমেদ : খালিয়াজুরী উপজেলার সাতগাঁও গ্রামে ১৯৪৭ সালে জন্ম গ্রহণ করেন। তিনি করাচী বিশ্ব বিদ্যালয় থেকে ১৯৬৯ সালে এম.এ ডিগ্রী গ্রহন করেন। সুলতান আহমেদ সেন্ট্রাল গভঃ সেকেন্ডারী স্কুল করাচী, বঙ্গবন্ধু কলেজ হোমনা কুমিল্লা এবং মোহনগঞ্জ কলেজ অধ্যাপনা করেন। (৮) অঞ্জন কুমার দেব রায় : খালিয়াজুরী সদর ইউনিয়নে জন্ম গ্রহণ করেন অঞ্জন কুমার দেব রায়। তিনি ইংল্যান্ডের ব্রাডফোর্ড ইউনিভার্সিটি থেকে উচ্চতর ডিগ্রী গ্রহণ করেন। তিনি প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রনালয় বাংলাদেশ সচিবালয়ে কর্মরত। (৯) আব্দুল মান্নান : খালিয়াজুরী উপজেলার ইচাপুর গ্রামে আব্দুল মান্নান জন্ম গ্রহণ করেন। তিনি বাংলাদেশ প্রকৌশলী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বি.এস-সি ইঞ্জিনিয়ারিং (সিভিল) ডিগ্রী গ্রহণ করেন। আব্দুল মান্নান নিজ পেশায় যথেষ্ট সুনাম অর্জন করেছেন। (১০) অধ্যাপক মন্টু সরকার : খালিয়াজুরী উপজেলার হায়াতপুর গ্রামে ১৯৫৯ সালে অধ্যাপক মন্টু সরকারের জন্ম। হোমিও চিকিৎসায় তিনি উচ্চতর ডিগ্রী গ্রহণ করেন। রেমী প্রসাধনী ও সজীব টি তারই উদ্ভাসিত পণ্য। জীবন সংগ্রামী হিসেবে তিনি খালিয়াজুরীর দৃষ্ঠান্ত। এস.এস.সি পরীক্ষার ফি সংগ্রহ করতে তিনি মানুষের বাড়ীতে কামলা কেটেছেন। বর্তমানে একজন সফল ব্যবসায়ী শিপ্পপতি । প্রাক্তন অধ্যাপক ঢাকা হোমিও কলেজ। (১১) ব্রজ গোপাল সরকার : খালিয়াজুরী উপজেলার চাকুয়া গ্রামে ৩১ শে জানুয়ারী ১২৯৫৪ খ্রীঃ জন্ম গ্রহণ করেন ব্রজ গোপাল সরকার। ছাত্র জীবন থেকেই কমিউনিজন আন্দোলনের সঙ্গে সম্পৃক্ত। খালিয়াজুরী, মদন ও মোহনগঞ্জে কৃষকদের রাজনীতি সচেতন করতে তিনি এখনো কাজ করে যাচেছন। ১৯৯১ সালে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির মনোনয়ন নিয়ে খালিয়াজুরী, মদন ও মোহনগঞ্জ আসন থেকে নির্বাচন করে ছিলেন। ==বিবিধ==খালিয়াজুরী উপজেলার বার্ষিক একমাত্র বিনোদন নৌকা বাইচ । বছরের শ্রাবণ মাসের শেষ দিনে মনষাপুজা উপলক্ষ্যে সে নৌকা বাইচের আয়োজন হয়। সে নৌকা বাইচের দীর্ঘ বছর ধরে আয়োজন করে আসছে ইছাপুর ও খলাপাড়া গ্রামবাসী। নৌকা বাইচে পুরস্কারের ব্যবস্থা রয়েছে। যে সকল গ্রামের নৌকাবাইচের দল অংশ নেয় সে দলের পে সমগ্র গ্রাম বিভিন্ন ভাবে সহযোগিতা করে। যেন সমস্ত গ্রামবাসীর মান- সম্মান সে প্রতিযোগিতার সঙ্গে জড়িত। সম্প্রতিবালে খালিয়াজুরীর নৌকাবাইচে মন্ত্রী, আমলারা অতিথি হিসেবে আসেন।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন